- লালবাজার থেকে বলছি।
কলকাতার বাসিন্দা হলে এই বাক্যটি শোনামাত্র চোখের ওপর কী ভেসে ওঠে? বিশাল লাল বাড়ি, বড় গেটের সামনে সশস্ত্র প্রহরী, উর্দিধারীদের অবিরাম আসাযাওয়া?
লালবাজার বলতে কেউ কোনও এলাকা বোঝে না। একটা বাড়ি বোঝে, কলকাতা পুলিশের সদর দফতর বোঝে। অথচ লালবাজার স্ট্রিট একটি রাস্তাবিশেষ, যে রাস্তায় ঘটনাচক্রে অবস্থান শহরের পুলিশের মূল পরিচালনকেন্দ্রের। একটি সরকারি দফতরের প্রশাসনিক ভবনের সঙ্গে একটি এলাকার এভাবে সমার্থক হয়ে যাওয়ার উদাহরণ সম্ভবত ভূভারতে আর নেই।
কী রয়েছে এই লালবাজার নামের নেপথ্যে?
স্বল্প পরিসর, তাই খুব বিশদে যাওয়া উদ্দেশ্য নয়। এই শহরের ইতিহাস বিষয়ে যাঁরা আগ্রহী, তাঁদের একটু ভিন্ন স্বাদের লেখা উপহার দেওয়াই উদ্দেশ্য।
অনেককেই আমরা বলতে শুনি, কলকাতা পুলিশের সদর দপ্তরের বাড়ির রং লাল বলেই নাম ‘লালবাজার’। একথার যে কোনোই ভিত্তি নেই, তা শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো।
এও বলে নেওয়া উচিত যে ‘লাল’ শব্দটির সূত্রপাতের কারণ দর্শাতে কেউ কেউ তৎকালীন পুলিশ কনস্টেবলদের লাল পাগড়ির প্রসঙ্গও নিয়ে আসেন। যদিও এলাকার নাম লালবাজার হওয়ার বেশ কিছুকাল পর থেকে লাল পাগড়ি পরতে শুরু করেন কনস্টেবলরা।
প্রায় আড়াইশো বছর আগে আজকের বিবাদী বাগ এলাকার উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে বৌবাজার পর্যন্ত ছিল বর্তমানের লালবাজার স্ট্রিটের ব্যাপ্তি। ইংরেজদের মতে এটি ছিল ‘বেস্ট স্ট্রিট অফ ক্যালকাটা’। লন্ডনের রাস্তার আদলে বানানো এই সড়কের নাম ব্রিটিশরা দিয়েছিল ‘অ্যাভিনিউ টু দ্য ইস্টওয়ার্ড’। তবে কেউ কেউ বলতেন ‘গ্রেট বাংলো রোড’। কারণ এই রাস্তাতেই অবস্থিত ছিল একটি প্রাসাদোপম বাড়ি, যার মালিক ছিলেন তৎকালীন কলকাতার অন্যতম ধনকুবের ব্যবসায়ী তথা দানবীর জন পামার। অনন্ত দানধ্যানের দৌলতে যাঁর শেষ জীবন কাটে অপরিসীম দারিদ্রে।
সেই রাস্তা আজও আছে। আছে সেই বাড়িও। তেরোটি আর্চ এবং ‘পোরবন্দর থাম’ (Porebunder Columns) সম্বলিত সেই দক্ষিণমুখী চারতলা বাড়িতেই অধিষ্ঠান কলকাতা পুলিশের প্রধান কার্যালয়ের – লালবাজার।
লালবাজারের নামকরণ সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত ইতিহাসের পাতায়, গবেষণার নথিতে। কেউ বলেন, তৎকালীন লাল রঙের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ছায়া পড়ত লালদীঘিতে। সেই থেকেই এলাকার নাম লালবাজার। ১৭৫৬ সালে কলকাতায় নবাব সিরাজদৌল্লার হামলার পর ‘নিউ’ ফোর্ট উইলিয়াম নির্মিত হয় তার বর্তমান ঠিকানায়, এবং পুরাতন দুর্গের ওপর গড়ে ওঠে আজকের জিপিও বা জেনারেল পোস্ট অফিস।
আবার অনেকে অনুমান করেন, বর্তমান লালবাজার এলাকায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের একটি কাছারিবাড়ি ছিল। দোলের সময় লালদীঘি ও তার সংলগ্ন এলাকা আবির ও কুমকুমের রঙে লালবর্ণ ধারণ করত। সেই থেকেই লালবাজার নামকরণ।
রেভারেন্ড জেমস্ লং (১৮১৪–৮৭) লাল ইটের তৈরি মিশন চার্চ বা লাল গির্জাকে লালবাজারের নামকরণের কারণ হিসেবে ইঙ্গিত করেছিলেন। এই গির্জাটি ১৭৬৮ সালে নির্মাণ করেন জন জাকারিয়া কিয়েরন্যান্ডার, যিনি ছিলেন বাংলার প্রথম প্রোটেস্টান্ট পাদ্রী। তবে রেভারেন্ড লং-এর থিওরি সম্ভবত ভুল, কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নথিপত্রে ১৭৪৫ সাল থেকেই লালবাজারের উল্লেখ পাওয়া যায়।
জন হলওয়েল, যিনি ১৭৫১-৫৬ পর্যন্ত কলকাতার কালেক্টর ছিলেন, এই এলাকার সম্পর্কে বলেছেন, এটি বাজার নয়, বরং জনবসতি হিসেবেই পরিচিত ছিল। দশ বিঘা নয় কাঠা জমি এবং প্রায় ৮০টি বাড়ি ছিল এই অঞ্চলে। তবে গবেষক ভোলানাথ চন্দ্র উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে লালবাজারকে একটি বাজার হিসেবেই চিহ্নিত করেন। তাঁর মতে, বাজারটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন লালমোহন বসাক, সুতরাং ‘লালবাজার’।
এই তত্ত্বের সমর্থনে কিছু তথ্য পেশ করা যায় বটে। কারণ, ব্যক্তিবিশেষের নামে কলকাতার একাধিক বাজারের নামকরণের ইতিহাস। যেমন ‘চার্লস বাজার’ (পরবর্তীকালে শ্যামবাজার), ‘জন’স বাজার’ (অধুনা জানবাজার), ইতালিয় ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড তিরেত্তার নামে ‘তিরেত্তা বাজার’ (পরে টেরিটি বাজার)। অতএব লালমোহন বসাকের নামে লালবাজারের নামকরণ একেবারে অসম্ভব নয়।
এছাড়াও আরও একটি মতের কথা বলা হয়নি এখনও।
অষ্টাদশ শতকের শেষের দিক থেকে লালবাজার এলাকায় উচ্চবিত্ত ব্রিটিশরা অনেকটা সময় কাটাতেন। লালদীঘি, লালবাজার, কসাইটোলা (অধুনা বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট) এবং বৌবাজার এলাকা জুড়ে গজিয়ে উঠেছিল অসংখ্য পানশালা বা ‘ট্যাভার্ন’, যার ফলে স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ প্রকাশ পায় ১৮৪২ সালে ‘বেঙ্গল হুরকারু’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠিতে, যার সারমর্ম, বহুসংখ্যক পানশালার উপস্থিতির কারণে এলাকার শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে নিয়মিত, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব কি দয়া করে কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন?
তখনকার বিখ্যাত ‘হারমোনিক ট্যাভার্ন’ – একাধারে পানশালা এবং প্রমোদভবন – অবস্থিত ছিল পামার-এর মূল বাড়িটির একেবারে গা ঘেঁষে। ইংরেজ নারী-পুরুষদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় ছিল এই ট্যাভার্ন, যা সুর এবং সুরায় জমজমাট হয়ে উঠত প্রতি সন্ধ্যায়। বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস-এর বিদায়সভাও আয়োজিত হয় এখানেই। ‘লাল’-এর উৎস সন্ধানে পুরনো নথিপত্রে ‘loll’ শব্দটিও পাওয়া গিয়েছে, যা ‘loll shraub’ বা ‘লাল শরাব’ অর্থাৎ লাল সুরার অপভ্রংশ। এই সূত্র ধরেই উল্লেখ পাওয়া যায় ‘Loll Bazar’-এরও।
অতীতের সেই হারমোনিক ট্যাভার্ন-এর স্থানে ১৮৯৮ সালে চালু করা আইন মোতাবেক গড়ে ওঠে প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত (সংক্ষেপে ‘পুলিস কোর্ট’), যে আদালতে ১২৫ টাকা বেতনে কিছুকাল দোভাষীর চাকরি করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যে আদালত সাক্ষী থাকে বাংলার অগ্নিযুগের অজস্র স্বাধীনতা সংগ্রামীর বিচারপর্বের। এবং যে আদালতের বর্তমান পরিচয় কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের প্রধান কার্যালয় হিসেবে।
তাই বলছিলাম, নানা মত। নিশ্চিত প্রমাণের অভাবে শেষ বিচারে নামের উৎস সন্ধান থেকে যায় অমীমাংসিতই। অবশ্য নামে কী-ই বা এসে যায়?
তথ্য ও ছবি সৌজন্য : কলকাতা পুলিশ