WIKI KOLKATA

উত্তর কোলকাতার প্রাচীন এই জনপথের দুপাশে গড়ে ওঠা প্রাচীন ও নবীন খাবারের দোকানের বিপুল সম্ভার

9.13K ফুড 2 years ago

Dibyendu Garai: বিধিসন্মত সতর্কীকরণ- ডায়াবেটিস এবং হাই কোলেস্টেরলের সমস্যা আছে এমন কেউ এই সুদীর্ঘ পোস্টটি নিজ দায়িত্বে পড়বেন।

শ্যামবাজার মোড় থেকে রামদুলাল সরকার স্ট্রিট, উত্তর কোলকাতার প্রাচীন এই জনপথের দুপাশে গড়ে ওঠা প্রাচীন ও নবীন খাবারের দোকানের বিপুল সম্ভার। কম-বেশী ২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তায় হাঁটতে যতটা সময় লাগবে আশাকরি এই পোস্টটি পড়তে তার থেকে বেশী সময় লাগবে না। তারপর খেতে ও খাওয়াতে কত সময় লাগবে সেটা সম্পূর্ণ আপনাদের ব্যপার।

সেই যে কথায় আছে না, ‘স্যাকরার ঠুকঠাক,কামারের এক ঘা’। চলুন, আজ কামারের এক ঘা দিয়েই দি। মানে, আজ কোন একটা পাইস হোটেল বা বড় রেস্টুরেন্টের ইতিহাস-ভূগোল না জানিয়ে উত্তর কোলকাতার বিশেষ অংশের খাবারদাবারের সুলুকসন্ধান করি। গেট-সেট-গো…

মানিকতলায় বসবাস আর হেদুয়া-ঠনঠনিয়া-শ্যামবাজারে স্কুল-কলেজ থাকায় ছোটবেলা থেকে এই জায়গাগুলোয় অগুণতি বার যাতায়াত করেছি। বিধান সরণী, যার শুরুয়াৎ শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড় থেকে, সেই রাস্তা-সেই ট্রামলাইন বরাবর হেঁটেছি বিভিন্ন সময়ে। ভোররাত থেকে মাঝরাত, গ্রীষ্মের দুপুর থেকে শীতের সন্ধ্যে, হরেকরকম স্বাদের আয়োজন দেখেছি, চেখেছি…

উত্তর কোলকাতার সিনেমাপাড়া আর থিয়েটার-পাড়া হিসেবে পরিচিত এই এলাকা সেই সময় থেকেই খাদ্যরসিকদের কাছে স্বর্গ। তখন অবশ্য মুখরোচক খাবার বলতে দই-মিষ্টি, তেলেভাজাই চলত, এখনকার মত কাবাব-বিরিয়ানি-চাইনিজের রমরমা ছিল না।

শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড়, ঠিক যেখান থেকে বিধান সরণী চলতে শুরু করেছে, সূচনা হোক সেখান থেকে…

দোকানের আসল নাম, নিউ পাঞ্জাবি হোটেল বললে কেউ তেমন চিনতে পারবে না। তবে আদর করে যে নামে ডাকা হয়, সেই নামে গোটা শহর, রাজ্য মায় রাজ্যের বাইরেও বহু বাঙালি একডাকে চেনে। ঠিক ধরেছেন আমি ‘গোলবাড়ি’র কথা বলছি। একদম শ্যামবাজার মোড়ের এই দোকান শুরু করেছিলেন রতন আরোরা নামের এক পাঞ্জাবী ভদ্রলোক, আজ থেকে ৯৫ বছর আগে। যে বাড়ির নীচে এই দোকান, সেই বাড়ির গোলাকৃতি শেপের জন্য এর নাম গোলবাড়ি। এখানকার বিখ্যাত খাবার হল পরোটা আর কষা মাংস। এছাড়া কাটলেট, মাটন চপ আরও অনেক কিছু পাওয়া যায়। বসে খাবার জায়গা অপ্রতুলতা, মাঝে কর্মী অসন্তোষের কারণে বেশ কয়েক বছর দোকান বন্ধ থাকা, খাবারের স্বাদের গুণমান হ্রাস পাওয়া… হরেক কারণ সত্ত্বেও আজও শ্যামবাজার তথা কোলকাতার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক গোলবাড়ি।

ঘোর আমিষভুক লোকজনের পর নিরামিষভোজী লোকেদের কথা খেয়াল রাখা উচিত। তাই শ্যামবাজার মোড় থেকে বিধান সরণী ধরে কয়েক পা এগোলেই ডান হাতে পড়বে এই এলাকার একমাত্র ভেজ রেস্টুরেন্ট ‘ডিমপি’। নামে ডিম থাকলেও এদের খাবারে ডিম-মাছ-মাংস-পেঁয়াজ-রসুন নেই। তবে খাবারের স্বাদ দুর্দান্ত। ধোসা থেকে নুডলস, লস্যি থেকে পোলাও সব ধরনের খাবার পাবেন এখানে। আর দামও পকেটের জন্য কষ্টকর নয়।

গোলবাড়ির মাংস, ডিমপির নিরামিষ খাবারের পর এবার চাইনিজ খাবারের স্বাদ নেওয়া যাক। কে.সি. দাস শপিং মলের উল্টোদিকের গলিতে, যেখানে ড্রিমল্যান্ড নার্সিং হোম রয়েছে, সেখানেই বেশ পুরোনো, ছোট, ঘরোয়া রেস্তোরাঁ ‘মোম্বাসা’। কলেজে পড়ার সময় পকেটমানি যখন কম থাকত, তখন মাঝেসাঝে যেতাম এখানে। কম খরচে ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন, কখনোসখনো স্যুপ। পকেট আর পেট দুটোই খুশি।

এবার আর একটু এগোলে ফড়িয়াপুকুর। এখন এখানে আমিনিয়া রেস্টুরেন্ট, ২০১৫ সাল থেকে। তার আগে এই জায়গায় ছিল ‘ফ্রেন্ডস কেবিন’। পুরোনো দিনের রেস্তোরাঁ, যেখানে চপ-কাটলেট-কবিরাজি আর মোগলাই পরোটা প্লেটের পর প্লেট উড়ে যেত, তাদের নামের সাথে কেবিন শব্দটা যুক্ত থাকত। বসন্ত কেবিন, সঞ্জীবনী কেবিন, অনাদি কেবিন, কালী কেবিন, দিলখুশা কেবিন, মুক্তি কেবিন প্রভৃতি। আসলে পুরোনো দিনের এসব রেস্তোরাঁ’তে পর্দা ঘেরা বসার জায়গা থাকত। ভীড়ের মধ্যেও খানিকটা আড়াল-আবডালে নিরিবিলি প্রেম জমত এইসব কেবিনে। ফড়িয়াপুকুরের ফ্রেন্ডস কেবিনে ফিসফ্রাই বা মোগলাই পরোটা, কখনো বা ফ্রায়েড রাইস খেয়েছি হাতিবাগানে কেনাকাটা করতে বা সিনেমা দেখতে গিয়ে। মধ্যবিত্তের সাধ্যের মধ্যেই ছিল এখানকার খাবার।

এর পাশের গলির মুখেই রয়েছে মিষ্টি দইয়ের অন্যতম ঠিকানা, ‘অমৃত’। ১৯৬৫ সালে পথচলা শুরু করে আজও বাঙালির মন জুগিয়ে চলেছে।

এই গলির আরেকটু ভেতর দিকে গেলে পড়বে ‘সেন মহাশয়’ মিষ্টির দোকান। বহু পুরাতন এই দোকানের মিষ্টি ছাড়াও রাধাবল্লভী বেশ বিখ্যাত।

ফড়িয়াপুকুর মোড়ের ডান দিকের গলির মুখে রয়েছে ’সঞ্জীবনী কেবিন’। আর গলির একটু ভেতরে গেলে ‘প্রিয়া’ হোটেল আর ‘মনোলোভা’ হোটেল, পাশাপাশি। হোটেল প্রিয়া’র রকমারি মাছের পদগুলোর স্বাদ খুব ভালো। সবরকম মাছ পাওয়া যায়। এই এলাকায় দুপুরবেলা বাঙালি পদ দিয়ে ভুরিভোজ করতে হলে চোখকান বুজে প্রিয়া-তে চলে যেতে পারেন। এসি-র ঠান্ডা হাওয়া পাবেন না তবে খেয়ে মনপ্রাণ ঠান্ডা হবেই। রাতে এদের চিকেন-তরকা আর রুমালি রুটি’র কম্বো জাস্ট দুর্দান্ত। এর পাশেই রয়েছে মনোলোভা হোটেল। খাবারের পদ মোটামুটি একই রকম। দামও আয়ত্তের মধ্যে।

ফড়িয়াপুকুর থেকে আরও দক্ষিণে গেলে বামহাতে পড়বে ‘দিলরুবা রেস্টুরেন্ট’। দর্পণা সিনেমাহলের একটু আগে। পুরোনো দিনের রেস্টুরেন্ট, প্রবেশপথ সরু, কিন্তু ভেতরে ঢুকে অনেকজন বসার জায়গা আছে। চপ-কাটলেট-ফিশফ্রাই-পুডিং পাবেন আবার মোমো-চাউমিনও। ১৯৪৯ সালে তৈরি হওয়া এই রেস্টুরেন্টের ভেতর বেশ একটা নস্ট্যালজিক আবহাওয়া আছে। আধুনিক যুগের সাথে যতদিন পাল্লা দিয়ে টিকে থাকবে ততদিনই মঙ্গল।

দর্পণা সিনেমাহল থেকে একটু এগোলেই রাস্তার বামদিকে ‘মিত্রা’ (বর্তমানে বাজার কোলকাতা) আর ডানদিকে ‘মিনার’ সিনেমাহল (এখনও চালু)। এই মিনারের একদম গা ঘেঁষে রয়েছে ‘ক্যাফে ডি লাইট’ ফাস্টফুড সেন্টার। অনেকদিন মিনারে সিনেমা দেখার আগে বা পরে এখান থেকে এগরোল কিনে খেয়েছি। বেশ পুরোনো এই দোকান এখনও পরিষেবা দিয়ে চলেছে।

এখান থেকে কয়েক পা দূরত্বে শিকদারবাগান। এই গলিতেই রয়েছে ‘আদি মালঞ্চ কর্মিবৃন্দ রেস্টুরেন্ট’। ৪৫ বছরের পুরোনো এই রাস্তার দোকানটি শুরু করেছিল মালঞ্চ রেস্টুরেন্টে কর্মীরা, মূল রেস্টুরেন্টটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর। সন্ধ্যেবেলা গেলে ভীড় দেখেই দোকানটি চিনতে পারবেন। নানা রকমের চপ-কাটলেট পাওয়া গেলেও আমার ব্যক্তিগত পছন্দ চিকেন কাটলেট আর মাটন-কবিরাজি। বহুবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিনামাটির প্লেটে স্যালাড ও কাসুন্দি সহ কাটলেট চিবিয়েছি। এখন অবশ্য পোস্ট-কোভিড যুগে কাগজের প্লেটে পরিবেশন করা হয়।

মেন রাস্তার (বিধান সরণী) ডানদিকের গলির (টাউন স্কুলের গলি) মুখেই জিভে জল আনা ফুচকার দোকান। পরপর বেশ কয়েকটি ফুচকার দোকানের বাস এখানে। টকজল আর ভাজা মশলার গন্ধে বিকেল থেকে রাত অব্দি জায়গাটা ম-ম করে। এই গলি দিয়ে একটু ঢুকলেই পরপর অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট। পুরোনো দের মধ্যে আছে ‘সুতানুটি’, ‘গজব’ আর ‘মাদ্রাজ টিফিন’, অপেক্ষাকৃত নতুন ‘আরসালান’। ২০১৩ সালে আরসালান এখানে ব্রাঞ্চ খোলার পর সুতানুটি আর গজব রেস্টুরেন্টের একচেটিয়া আধিপত্যের অবসান ঘটে। তার আগে এই দুটো রেস্টুরেন্ট রমরম করে চলত। আর আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুবাদে সুতানুটিতে ছিল আমাদের জন্য বিশেষ ছাড়। কারণ এই রেস্টুরেন্টের মালিক বা তার খুব কাছের কেউ আরজিকরের ছাত্র ছিল। তাই ওখানকার ছাত্রছাত্রীদের খাবারের সার্ভিস ট্যাক্স লাগত না। এখানকার একমাত্র দক্ষিণ-ভারতীয় খানার ঠিকানা ছিল মাদ্রাজ টিফিন। বিশাল আরসালানের নীচে এখনও রয়েছে সেই রেস্তোরাঁ।

টাউন স্কুল ছাড়িয়ে বিধান সরণী বরাবর দক্ষিণদিকে হাঁটলে পরপর তিনটে সিনেমাহল পড়ত। শ্রী, উত্তরা ও রাধা। এখন যথাক্রমে কেএফসি ফুডমার্ট, সিটিমার্ট আর বাজার কোলকাতা শপিং মল। কেএফসি, ওয়াও মোমো, স্কুপ এসব আধুনিক রেস্তোরাঁর আগে এই চত্বরে ‘সুপ্তি’ নামক একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। রাধা ও উত্তরা সিনেমাহলের মাঝে অবস্থিত দোতলার উপরের এই রেস্টুরেন্ট ছিল আমার কলেজ লাইফের ভালোমন্দ খাওয়ার ঠিকানা। প্রতিবছর দুর্গাপুজোর রাতে ডিনার করতাম এখানে, বন্ধুরা মিলে। গ্রেভি চাউমিন আর চিলিচিকেনের বেশি পকেট পারমিট করত না, সেটাও আবার শেয়ার করে। অনেকদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে সুপ্তি।

রাধা হলের নীচে রয়েছে প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরাতন ‘কে.সি. গোপ’। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মিষ্টির দোকানে মিষ্টি ছাড়াও যেসব খাবার খেতে মানুষের ভীড় জমে তা হল, রাধাবল্লভী-আলুর দম, ধোকলা, কুলফি মালাই, লস্যি।

রাধা সিনেমাহলে পেরোলেই হাতিবাগান মোড় (বিধান সরণী ও গ্রে স্ট্রিটের সংযোগস্থল)। বামদিকের রাস্তা চলে গেছে খান্না আর ডানদিকে সোজা শোভাবাজার। এই মোড়েই রয়েছে ‘কেয়ার অফ বাঙালি’ ও ‘ভজহরি মান্না’ (স্টার হলের নীচে) নামক দুটি বাঙালি রেস্টুরেন্ট। এই দুটি রেস্টুরেন্ট বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন। প্রাচীন একটি রেস্তোরাঁরও দেখা মিলবে এখানে। দোতলায় অবস্থিত ‘মিতালি’ হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট বহুদিন ধরেই ভাত-মাছ এবং চাউমিন-চিলিচিকেনের বিশ্বস্ত ঠিকানা।

এই মোড় থেকে ডানদিকের রাস্তা (গ্রে স্ট্রিট) ধরে একটু এগোলেই ‘নব মালঞ্চ’ রেস্টুরেন্ট। নামে ‘নব’ থাকলেও বয়সে মোটেই নবীন নয়, বরং প্রবীণ। প্রায় বছর পঞ্চাশ ধরে এই রেস্টুরেন্ট চপ-কাটলেট-মোগলাই-চাউমিনের প্রাপ্তিস্থল।

হাতিবাগান মোড় থেকে কর্পোরেশন বিল্ডিংকে বাঁ দিকে রেখে এগিয়ে গেলে ‘রূপবাণী’ সিনেমাহলের (বর্তমানে ফ্ল্যাটবাড়ি, শুশ্রুত আই সেন্টার) পাশেই রয়েছে ‘সাগর রোল সেন্টার’। আমাদের স্কুল-কলেজবেলায় এগরোল খাওয়ার অন্যতম আড্ডা ছিল এই সাগর। রূপবাণী হলের একদম গায়েই ছিল রেস্টুরেন্ট পূর্বাণী। সেখানকার মাংসের সিঙারা’র ফ্যান ছিলাম আমি। হাতবদল হয়ে বর্তমানে সেই রেস্টুরেন্ট এখন ‘সাগর এসি রেস্টুরেন্ট’।

এর উল্টোদিকে, রাস্তার ডানদিকে পেট্রোল পাম্প আর তার পাশেই ‘ফিউশন’ মালটিকিউজিন রেস্টুরেন্ট। গ্রাউন্ড ফ্লোরে রোল-সেন্টার আর টেক-অ্যাওয়ে। ফার্স্ট আর সেকেন্ড ফ্লোরে ডাইনিং। ১৫ বছর পুরোনো এই রেস্টুরেন্টে মোগলাই থেকে চাইনিজ সবরকম পদই পাওয়া যায়। খাবারের মান মোটামুটি।

আরও দক্ষিণে গেলে রাস্তার ডানদিকে পড়বে ১০০ বছরেরও বেশি পুরোনো তেলেভাজার দোকান, ‘লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ এন্ড সন্স’। ১৯১৮ সালে শুরু হয়েছিল এই দোকান। আজও এই দোকানের রকমারি চপ-তেলেভাজা খেতে মানুষ ভালোবাসে। আলুরচপ, পেঁয়াজি, ধোকা, বেগুনি, পনীর-চপ, ডালবড়া অনেককিছুই মেলে এখানে। শোনা যায়, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বিপ্লবীদের দেখা করার জায়গা ছিল এই দোকান। তৎকালীন দোকানের মালিক এখানেই দেখেছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস‘কে। এতটাই মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন যে এরপর প্রতি বছর ২৩শে জানুয়ারি, নেতাজির জন্মদিনে বিনামূল্যে মানুষকে চপ-তেলেভাজা দেওয়া শুরু করেন। সেই প্রথা আজও চলছে। স্থানীয় লোকেরা ভালোবেসে এই দোকানকে ডাকে আর একটি নামে, ‘নেতাজির পেঁয়াজির দোকান’।

এই দোকানের ঠিক উল্টোদিকে আছে ‘রক্ষাকালী নিরামিষ তেলেভাজা’র দোকান। এখানকার তেলেভাজার স্বাদ অপূর্ব। ছোট্ট দোকান হলে কি হবে এদের ভাঁড়ারে রকমারি চপের দেখা মিলবে। হেলেঞ্চা পাতার চপ, পলতা পাতার চপ, কাঁচা আমের চপ এরকম অনেক চপ পাওয়া যায় এখানে, সচরাচর অন্য দোকানে যা পাওয়া যায় না।

লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ এর চপের দোকানের ঠিক পাশের গলি (বৃন্দাবন বোস লেন) দিয়ে ঢুকে হরি ঘোষ স্ট্রিটে পড়লেই বাঁদিকে দেখতে পাবেন শতাব্দী প্রাচীন মিষ্টির দোকান ’ননী লাল ঘোষ’। প্রায় ১৪০ বছর পুরোনো এই দোকানে এখনও স্বল্পমূল্যে সন্দেশ পাওয়া যায়। হরি ঘোষ স্ট্রিট ধরে একটু এগোলেই বাঁ হাতে পড়বে ভীম ঘোষ স্ট্রিট। এখানেই রয়েছে আরও একটি প্রাচীন ও ছোট্ট মিষ্টির দোকান ‘কাশী নাথ পান’ মিষ্টান্ন ভান্ডার। এখানের বিশেষত্ব হল সাদা মিষ্টি দই। কোলকাতা যে দই এর জন্য বিখ্যাত তা হল লাল-দই। খুব কম দোকানেই সাদা-মিষ্টি দই পাওয়া যায়। এই দোকান হল তার মধ্যে একটি। সুস্বাদু মিষ্টি দই ছাড়াও এখানে অবিশ্বাস্য ‘দামে কম-মানে ভালো’ সন্দেশ-মিষ্টি পাওয়া যায়। এছাড়া শীতকালে নলেন গুড়, মোয়াও বিক্রি করেন এরা। এই ভীম ঘোষ স্ট্রিট ধরে সোজা হাঁটলে আবার বিধান সরণীতে পড়বেন, স্কটিশ চার্চ স্কুলের ঠিক উল্টো দিকে।

আবার বিধান সরণী ধরে দক্ষিণদিকে হাঁটলে ডানহাতে পড়বে লস্যির দোকান ‘ শিব আশ্রম’। ১৯৭৩ সালে তৈরি এই দোকানে সারা বছর নানা ধরনের শরবৎ-লস্যি পাওয়া গেলেও সবচেয়ে বেশি ভীড় হয় দোলের সময়। সিদ্ধির শরবৎ খেতে। কোলকাতার যে দু-তিনটে দোকান আইনসিদ্ধ ভাবে সিদ্ধি বিক্রয় করে, এটি তার অন্যতম।

আর কিছুটা এগোলে হেদুয়া। এখানেই একদম মোড়ের মাথায় বামহাতে রয়েছে নিউ ’বসন্ত কেবিন’। ১৯৪০ সালে তৈরি এই রেস্টুরেন্টের পরিবেশ এখন সাবেক কোলকাতার রেস্টুরেন্টের মত। চপ-কাটলেট-চাউমিন ছাড়াও এদের বিশেষ ডিশ ছিল মাছের কচুরি। অসাধারণ স্বাদ।

এই হেদুয়ার মোড় থেকে বাদিকের রাস্তা ধরে (বিডন স্ট্রিট) এগোলে পরপর বেশ কয়েকটা রেস্টুরেন্ট পরে। ব্লসম, মাশরুম, ফ্যাটসো, ক্যাপ্রি। সব রেস্টুরেন্টগুলো আয়তনে ছোট, খাবারের স্বাদ মন্দ নয় এবং বেশ পকেট-ফ্রেন্ডলি।

এখান থেকে হেদুয়া পার্ককে বাঁদিকে আর শতাব্দী প্রাচীন বেথুন স্কুল ও ক্রাইস্ট চার্চকে ডানদিকে রেখে এগোলে পড়বে রামদুলাল স্ট্রিট। ডানদিকের গলিতে রয়েছে উত্তর কোলকাতার গর্ব ‘গিরিশ চন্দ্র দে এন্ড নকুড় চন্দ্র নন্দী’।

১৮৪৪ সালে সিমলে পাড়ার মহিশ দে রামদুলাল স্ট্রিটে শুরু করেন এই মিষ্টির দোকান। ওঁর একমাত্র পুত্র গিরিশ চন্দ্র দে এরপর দোকানের দায়িত্ব নেন। গিরিশ দে’র একমাত্র কন্যার সাথে বিয়ে হয় জনাই-নিবাসী নকুড় চন্দ্র নন্দী’র। উনিও ছিলেন মিষ্টি-ব্যবসায়ী। এরপর নকুড় নন্দী চলে আসেন কোলকাতায়। শ্বশুর-জামাতা মিলে যৌথভাবে দায়িত্ব নেন এই দোকানের। বর্তমানে নকুড় নন্দীর উত্তরাধিকাররা এই দোকান চালাচ্ছেন, কারণ গিরিশ চন্দ্র দে’র কোন উত্তরাধিকার এখন আর বেঁচে নেই। এই দোকানের বিশেষত্ব হল দুটি। এক, এরা আজও হাতেই সমস্ত সন্দেশ তৈরি করেন। কোন মেশিন ব্যবহৃত হয় না। আর দুই, এখানে প্রথম থেকেই আক্ষরিক অর্থে কেবলমাত্র সন্দেশ পাওয়া যায়। কোনরকম রসের মিষ্টি, দই, নোনতা খাবার এরা আজও তৈরি করে না। শুধুমাত্র সন্দেশ তৈরির এই কৌলীন্য আর কোন মিষ্টির দোকানে নেই। ঐতিহ্যবাহী এই দোকানে বিভিন্ন ধরনের সন্দেশ পাওয়া যায়। পুরানো যুগের বাবু সন্দেশ, পারিজাত, আবার খাবো, চন্দ্রপুলি, দিলখুশ থেকে আধুনিক যুগের চকোলেট সন্দেশ, বাটারস্কচ সন্দেশ, গোলাপী প্যাঁড়া, ব্ল্যাক ফরেস্ট সন্দেশ… তালিকা সুদীর্ঘ। এখানে সিঙারাও মেলে, তবে তার বাইরেটা ক্ষীরের তৈরি আর ভেতরে আলুর পুরের বদলে ড্রাইফুটের পুর।

এই রামদুলাল স্ট্রিটে নকুড় ছাড়াও আরও কয়েকটা প্রাচীন মিষ্টির দোকান আছে। নলিন চন্দ্র দাস ১৯৫ বছরের পুরোনো। সুবোধ চন্দ্র মল্লিক, কালী চরণ দাস, ঘোষ সুইটসও বেশ অনেকদিনের দোকান। প্রতিটি দোকানের রসগোল্লা, নলেন গুড়ের সন্দেশ, রাবড়ি বেশ ভালো খেতে।

ম্যাপ / ছবি : Dibyendu Garai

Latest Update