সৌম্য দাস: সুপ্রাচীন নগর কলকাতা। এই শহরের প্রতিটি কোনায় লুকিয়ে রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস। বহু ঘটনার সাক্ষী এই শহর। অসংখ্য বিখ্যাত মানুষের যেমন জন্ম হয়েছে এই শহরে তেমনি অসংখ্য সুপ্রাচীন বিল্ডিং আজও সগর্বে মাথা উঁচু করে বহন করে চলেছে এই শহরের ইতিহাস। গতকাল ছিল ইংরেজি বছরের প্রথম দিন। সেই উপলক্ষে ঘুরে এলাম এমনি দুটো প্রাচীন স্থাপত্য থেকে। তার সাথে উপরি পাওনা সুন্দর একটি পার্ক। এবার স্থানগুলোর কথা বলি। ১. মেটকাফ হল; ২. সেন্ট জন্স চার্চ; ৩. মিলেনিয়াম পার্ক।
মেটকাফ হল -: কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যের নিদর্শন হলো এই মেটকাফ হল। যেটি প্রকৃতপক্ষে একটি মিউজিয়াম। এই হলের ইতিহাস একটু বলে রাখি। স্যার চার্লস থিওফিলাস মেটকাফ ছিলেন ভারতবর্ষের একবছরের গভর্নর জেনারেল। লর্ড বেন্টিঙ্কের পরে ১৮৩৫-৩৬ পর্যন্ত ছিল তাঁর মেয়াদ। কিন্তু, তার মধ্যে একটি যুগান্তকারী কাজ ভদ্রলোক করেছিলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ইংরেজ সরকার এতখানি উদারতা মেনে নেয়নি। তাকে একবছরের মধ্যে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই দেশের সাধারণ মানুষ তাহাকে মনে রাখে। দুই দেশের মানুষ কমিটি তৈরি করে এই বিল্ডিং তৈরি করা শুরু করে। ১৮৪০ সালে এই বিল্ডিং তৈরি করা শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৮৪৪ সালে। এই বিল্ডিংটির নকশা তৈরি করেন সি. কে. রবিনসন। সারি সারি থাম দিয়ে ঘেরা হলের অন্দর। থামের সংখ্যা ৩০। আর সেগুলি উচ্চতায় প্রায় ৩৬ ফুট। বেসমেন্ট থেকে থামগুলি সোজা উঠে গেছে একেবারে ছাদে। ইউরোপীয় গ্ৰিসের এথেন্স নগরীর Tower of Winds এর অনুকরণে এই হল তৈরি করা হয়। হলের প্রতিটি কোনায় লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস। এই হলের মেঝেতে আঁকা রয়েছে অপূর্ব আল্পনা। এছাড়াও অসংখ্য পুরোনো জিনিস সুন্দর করে সুসজ্জিত রয়েছে এই হলের দুটি তলা মিলিয়ে। ইতিহাস ভালোবেসে অবশ্যই একবার ঘুরে আসা যায় এই মেটকাফ হলে।
সেন্ট জন্স চার্চ-: মেটকাফ হল থেকে বেরিয়ে আমরা যাত্রা করলাম আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য সেন্ট জন্স চার্চের উদ্দেশ্যে। সেন্ট জন্স চার্চ কলকাতার তৃতীয় পুরোনো চার্চ। এর ইতিহাস একটু জানিয়ে রাখি। রাজভবনের উত্তরপশ্চিম কোণের এই জমিতে অতীতে ছিল কবরখানা, পরবর্তীকালে তা ব্যবহৃত হত গোলাবারুদ রাখার কাজে। তারপর এর মালিকানা যায় শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেবের হাতে। চার্চ তৈরির জন্য জমি তিনিই দান করেন। চার্চ তৈরির খরচ সংগৃহীত হয়েছিল লটারির মাধ্যমে। ১৭৮৪ সালের ৬ এপ্রিল ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। নির্মাণকার্য শুরু হয় লন্ডনের ‘সেন্ট মার্টিন-ইন-দ্য-ফিল্ডস’-এর আদলে, স্থপতি ছিলেন ‘বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ার্স’-এর লেফটেন্যান্ট জেমস আগ। ১৭৮৭ সালে তৈরি হয় চার্চ, তখন নাম ছিল অ্যাংলিকান ক্যাথেড্রাল অব ক্যালকাটা। ১৮৪৭ সালে সেন্ট পলস ক্যাথেড্রাল তৈরি হওয়া পর্যন্ত এ চার্চ ক্যাথেড্রালই ছিল।
চার্চের উত্তর ও পূবদিকে রয়েছে আটটি করে কম্পাসের মাথা-অলা জানলা, ছাদ সমতল, অভ্যন্তরে ভারবহনকারী ডরিক কলাম। প্রবেশের ঢালুপথ তৈরিই হয়েছিল তখনকার মূল যান পাল্কির কথা মাথায় রেখে। ইট ও পাথরে তৈরি নিওক্ল্যাসিকাল ধারার এই স্থাপত্যের ১৭৪ ফুট উঁচু পাথরের টাওয়ারে রয়েছে সুপ্রাচীন ঘড়ি, আজও প্রতিদিন তাতে দম দেওয়া হয়। এই চার্চের মধ্যেই চিরশায়িত রয়েছে ভারতের বড়োলাট লর্ড ক্যানিং এর স্ত্রী লেডি ক্যানিং। চার্চের ভিতরে দেওয়াল গাত্রে খোদিত রয়েছে মার্বেল পাথরের কিছু সুন্দর মূর্তি। গোটা চার্চ অপূর্ব সুন্দর লেগেছে। চার্চের ভিতরে কিছু স্তম্ভ রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো বিতর্কিত অন্ধকূপ হত্যা কে স্মরণ করে হলওয়েল মনুমেন্ট। সব মিলিয়ে গোটা চার্চের মধ্যে যেন থমকে রয়েছে সুপ্রাচীন কলকাতার ইতিহাস।
মিলেনিয়াম পার্ক:- চার্চ থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম আমাদের শেষ গন্তব্য বহুল পরিচিত মিলেনিয়াম পার্ক। এটি কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি পার্ক। এটি আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে এর অবস্থানের কারণে। এটি গঙ্গার তীরে অবস্থিত হওয়ায় এটি অপূর্ব লাগে। এটি নিয়ে সবাই কমবেশি জানে। তাই এই নিয়ে বিস্তারিত লিখলাম না।
পথনির্দেশিকা-: আমি যেটি দিয়ে গেছি – হাওড়া জেটি ঘাট থেকে লঞ্চে মিলেনিয়াম পার্ক ঘাট। ঘাটের পাশেই অবস্থিত মিলেনিয়াম পার্ক। আর এই ঘাট থেকে ৫ মিনিট হাঁটা পথে মেটকাফ হল। আর মেটকাফ হল থেকে হাঁটা পথে ৫ মিনিট হলো সেন্ট জন্স চার্চ।