সৌমেন্দু ঘোষ: এই প্রথম আমার স্কাই ওয়্যাকে চড়া। দয়া করে আমার কথার মধ্যে রাজনীতি টেনে আনবেন না, তবে আমার খুব ভালো লেগেছে এই স্কাই ওয়্যাক। আমার ব্যাক্তিগত মতে এতে এই গোটা জায়গার মান পৌঁছে গেছে অন্য স্তরে। আর তার সাথে বলতেই হবে যে এই জায়গাটা খুব সুন্দর করে মেনটেন করা।
৫ ই নভেম্বর ২০১৮ সালে প্রথম এটি সর্বসাধারণের জন্য চালু হয় (কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের মাঝামাঝি)। ৩৪০ মিটার লম্বা আর ১০.৫ মিটার চওড়া এই ব্রীজে মোট ১৪ টি চলমান সিড়ি, ৪ টি লিফট আর ৭ টি এমারজেন্সি এক্সিট আছে। স্কাই ওয়্যাক এ মোট ১৩৭ টি দোকান আছে।
যে দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রতি বছর প্রায় ১.৫ কোটি পর্যটক আসেন তাদের সুবিধার জন্যই বানানো এই ব্রীজ।
যাই হোক, যাবার পথেই আমরা একটি দোকানে আমাদের ব্যাগ রাখি ও পুজো দেবার সামগ্রী কিনে নিই। আমরা ৭৩ নম্বর দোকানে নিজেদের জিনিস রেখেছিলাম। আমাদের ভালো লেগেছিল। এখান থেকে হেঁটে আমরা প্রায় সকাল ৭.৩০ এর মধ্যেই পৌঁছে যাই মন্দিরে।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির প্রাঙ্গন:
এখানে পৌঁছে আবার একটা ব্যাপার খুব ভালো লাগলো। এখন মন্দির চত্বর টা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। আমি অনেক আগে যখন এসেছিলাম তখন এই মন্দির এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল না।
এখানে আছে একটি মূল কালী মন্দির, একটি রাধা কৃষ্ণের মন্দির আর ১২ টি শিব মন্দির। ১৮৫৫ সালে রাণী রাসমণি দেবী এই মন্দির বানান। শোনা যায় রানী রাসমণি যখন কাশি যাত্রা করেন তখন তিনি স্বপ্নাদেশ পান এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করার। নবরত্ন ধাঁচে তৈরি প্রধান মন্দিরের উচ্চতা ৩০ মিটার বা প্রায় ১০০ ফুট। পরবর্তী কালে এই মন্দিরের জনপ্রিয়তা আরো অনেক গুনে বাড়ে রামকৃষ্ণ পমহংসদেবের কারনে।
দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে আমার পুজো দেবার অভিজ্ঞতা:
যাই হোক আমরা খুব সকাল সকাল পুজো দিতে যাবার কারনে মন্দির বেশ ফাঁকা ছিল। তাই পুজো খুব ভালো ভাবে দিতে পারলাম। আমি তো বলবো যদি পুজো দেবার থাকে তো সকাল করেই আসুন। পুজো দিয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখলাম। এটা বলতেই হয়, গঙ্গার পাশে হওয়াতে সকালের মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়াতে চারপাশটা ঘুরতে খুব ভালো লাগে। এটা একটা আলাদা অনুভুতি।
পুজো শেষ করে বাইরে বেরোলাম। তারপর এখানেই একটা দোকান থেকে কচুরী আর রসগোল্লা খেলাম। তারপর আমাদের যে স্টলে ব্যাগ রাখা ছিল, সেখান থেকে ব্যাগ নিয়ে নিচে এলাম। আমি ঘুরে ঘুরে কিছু ছবি তুলালাম আর মা গেলেন পরিবারের বাকিদের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে। তারপর আমরা মা ভবতারিণী জেটি ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম বেলুড় মঠ যাবো বলে।
খেয়াল রাখবেন
১. দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে ভবতারিণী জেটি ঘাটের দূরত্ব খুবই কম আর এটা হেঁটেই চলে যাওয়া যায়। কিন্তু অটোতে উঠলেই ওরা ১০ টাকা জন প্রতি নেবে।
২. ভবতারিণী জেটি ঘাট থেকে বেলুড় মঠ ঘাট যাবার লঞ্চ এর টিকিটের দাম ১১ টাকা প্রতি জন।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির থেকে বেলুড় মঠ:
এটাও কিন্তু বেশ একটা বলার মত ব্যাপার। ভবতারিণী জেটি ঘাটে বেশ অনেকখানি হাঁটতে হয় জেটির ওপর দিয়ে, তারপর লঞ্চ ধরা যায়। এখানে লঞ্চ ছাড়ার পর গঙ্গা থেকে দক্ষিণেশ্বর মন্দির দেখার অনুমতি কিন্তু অনবদ্য। সেটা দেখার পর লঞ্চ প্রথমে পুরোনো বালি ব্রীজ আর তারপর নতুন বালি ব্রীজের নিচ দিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে বেলুড় মঠ ঘাটের দিকে এগোয়। মোহনার খুব কাছে হাওয়াতে এখানে গঙ্গা খুব চওড়া। দূরে গঙ্গা থেকে বেলুড় মঠ দেখতেও কিন্তু বেশ লাগে। আমি এখানে একটা ভিডিও বানালাম। দেখুন কেমন লাগে।
বেলুড় মঠ:
বেলুড় মঠের ঘাটে নেমেই প্রথমে আমরা সকলে মাটির ভাঁড়ে চা খেলাম। আহা!! এই স্বাদ কখনও পুরোনো হবে না। তারপর বেলুড় মঠ যাবার রাস্তা দিয়ে বেলুড় মঠ পৌঁছলাম।
বেলুড় মঠের ইতিহাস
রামকৃষ্ণ পমহংসদেবের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কাজ শুরু হয় ১৬ ই মে ১৯৩৫ সালে। এই মন্দিরের আর্কিটেকচারে খুঁজে পাওয়া যায় ক্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম এবং বৌদ্ধ ধর্মের সংমিশ্রন। এই বিশাল মন্দির নির্মান করেন মার্টিন বার্ন এন্ড কোম্পানি। এবং এই মন্দির সত্যিই খুব সুন্দর দেখতে। এখানে রামকৃষ্ণ মিশনের মতে এই মন্দির হল – “A Symphony in Architecture”
বেলুড় মঠে আমার অভিজ্ঞতা:
বেলুড় মঠ পৌঁছে প্রথমেই ভোগের কুপন নিলাম। এখানে কুপনের কোনো নির্দিষ্ট দাম নেই। আপনি নিজে যেটা ঠিক মনে করে দেবেন সেটাই দাম। এটা আমার বেশ ভালো লাগলো। এই উদ্যোগে অন্তত গরীব মানুষরা খিদে পেলে খেতে পাবে। যেমনটা হয় গুরুদ্বারা তে।
যাই হোক ভোগের কুপন কেটে গোটা বেলুড় মঠ টা ঘুরে দেখতে লাগলাম। খুব মন ভালো করা যায়গা এই বেলুড় মঠ। চারপাশ ঘুরে দেখছি এমন সময় দেখি এখানের মহারাজ আসছেন। সেও বেশ দেখাবার মত ব্যাপার। তার একটা ভিডিও করলাম। পরে জানলাম তিনি এসেছিলেন দুর্গা মূর্তি উন্মোচন করতে। তিনি প্রথমে গর্ভ গৃহে প্রবেশ করে রামকৃষ্ণ পমহংসদেবের অনুমতি নিয়ে বেলুড় মঠের দুর্গা মূর্তি উন্মোচন করতে গেলেন। এরপর জুতো খুলে জমা রেখে বেলুড় মঠের গর্ভ গৃহে প্রবেশ করলাম। এখানে নিস্তব্ধতা বজায় রাখতে হয়। আমি এখানে বসে ডাইরি লিখলাম। এরপর বেরিয়ে এখানের দুর্গা ঠাকুর দেখতে গেলাম।
দুর্গা পূজার পঞ্চমীতে এখানে আসার উপরি পাওনা হল বেলুড় মঠের দুর্গা পূজা। এখানের দুর্গা প্রতিমা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সাবেকি মাতৃরূপ। এক চালাতে এই দুর্গা প্রতিমার দিকে তাকালে মুখ ফেরানো যায় না। অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে ঠাকুর। বেশ কিছুক্ষন এখানে দাড়িয়ে ছিলাম। এর মধ্যে ভোগ খাবার সময় হয়ে এসেছে। তাই জমা রাখা জুতো আবার সংগ্রহ করে গেলাম ভোগ খেতে।
বেলুড় মঠের ভোগ
এখানে নতুন করে কিছু জায়গা বানানো হয়েছে যেখানে বসিয়ে ভোগ খাওয়ানো হয়। আমরা সেখানে গিয়েই বসলাম। প্রথমে এলো খিচুরী আর আলুর দম। তারপর আবার এল এই একই জিনিস। এরপর এলো চাটনি আর শেষে পায়েস। খুব তৃপ্তি করে খেলাম। তারপর খাওয়া শেষ করে রওনা হলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বেলুড় মঠ থেকে বেরিয়ে টো টো করে বেলুড় স্টেশনে পৌছালাম। সেখান থেকে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরলাম।
দক্ষিণেশ্বর আর বেলুড় মঠ এই দুই জায়গাই আমার খুব ভালো লাগলো।
লিখেছেন : সৌমেন্দু ঘোষ